সংসদ নির্বাচন আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন: প্রধান উপদেষ্টা
প্রকাশের সময় : জুন ৭, ২০২৫, ১২:৫৩ অপরাহ্ন |
২২
পাঠকবার্তা ডেস্ক
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘ বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে আপনাদের কাছে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রদান করবে।’
ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে তাঁরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সে বিবেচনায় আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার; যা কিনা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি সম্মিলিত দায়—সে বিষয়ে তাঁরা দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারবেন বলে ভাষণে জানান প্রধান উপদেষ্টা।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশের গভীর সংকটগুলোর জন্য ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে দায়ী করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বারবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল বর্বর ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছিল। এ ধরনের নির্বাচন যারা আয়োজন করে, তারা জাতির কাছে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। এমন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দল ক্ষমতায় আসে, তারাও জনগণের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বড় দায়িত্ব পরিচ্ছন্ন, উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ, বিপুলভাবে অংশগ্রহণের পরিবেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা, যাতে দেশ ভবিষ্যতে নতুন সংকটে না পড়ে। তিনি বলেন, এ জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। যে প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, সেগুলোতে যদি সুশাসন নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে ছাত্র-জনতার সব আত্মত্যাগ বিফলে যাবে।
ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’
আগামী জুলাই মাসেই সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই সনদ একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কয়টিতে একমত হয়েছে, তার তালিকা থাকবে এই সনদে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে রাজনৈতিক দলগুলো জাতির কাছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘জুলাই সনদ অনুযায়ী আশুকরণীয় সংস্কার কাজগুলো আমরা বাস্তবায়ন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাকি অংশের বেশ কিছু কাজও আমরা শুরু করে যেতে চাই। আশা করি, অবশিষ্ট অংশ পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে।’
করিডর দেওয়ার বিষয়টি ‘সর্বৈব মিথ্যা’
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য বাংলাদেশ করিডর দিয়ে দিয়েছে বলে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তাকে ‘সর্বৈব মিথ্যা’ বলে ভাষণে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প। যারা অসভ্য কল্পকাহিনি বানিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করে অশান্তি সৃষ্টিতে নিয়োজিত, এটা তাদেরই শিল্পকর্ম।’
জনগণকে এ বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কোনোভাবেই বিভ্রান্ত হবেন না। এসব অপপ্রচার সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্যচ্যুত হব না। এই জটিল সমস্যাটি সমাধানে আমাদের কাজ চালিয়ে যাব।’
প্রধান উপদেষ্টা জানান, জাতিসংঘের মহাসচিব গত মার্চ মাসে ঢাকা সফরকালে রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য একটি ত্রাণ চ্যানেলের প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই প্রস্তাবটি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহায়ক হবে। বিষয়টি প্রস্তাব পর্যায়েই রয়ে গেছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ও সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের সরকার সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তিনি যে দেশেই সফর করেছেন, সব দেশে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় নেতা ও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তাঁদের সহযোগিতা চেয়েছেন। সেসব দেশ ইতিবাচকভাবে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে সাড়া দিয়েছে বলে ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
‘তিনটি ম্যান্ডেট দেশবাসীর সঙ্গে আমাদের চুক্তি’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পতিত স্বৈরাচার বাংলাদেশকে যেভাবে ধ্বংসস্তূপ বানিয়েছে, সেখান থেকে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হলে ন্যূনতম তিনটি আবশ্যিক কাজ সম্পন্ন করতে হবে। যার প্রথমটি হলো বিচার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দৃশ্যমান করে তোলা। দ্বিতীয়টি, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কারসাধনে প্রয়োজনীয় ঐকমত্য ও পথনকশা তৈরি করা এবং সর্বশেষ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। সে লক্ষ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত নির্বাচনব্যবস্থাকে স্থায়ীভাবে সংস্কার করা। তিনি বলেন, ‘এই তিনটি ম্যান্ডেট হচ্ছে দেশবাসীর সঙ্গে আমাদের চুক্তি। ‘
জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার শুরু হয়েছে
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞসহ বিগত ১৬ বছরের গুম-খুন–নির্যাতনের সত্য উদ্ঘাটন এবং আর্থিক খাতের সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া তাঁরা শুরু করেছেন। তিনি বলেন, জুলাইয়ে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিচার ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বিচারকাজ যেন দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যত রকম সহযোগিতা প্রয়োজন তা তাঁরা দিচ্ছেন।
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো বিচারপর্ব আদালতের অনুমতিক্রমে সরাসরি কিংবা রেকর্ডকৃত পদ্ধতিতে গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, এতে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। বিচার নিয়ে অপপ্রচার বন্ধ হবে।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, বিগত সরকার পতনের পর তাদের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে। থানা, হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দলিলপত্র পুড়িয়ে বা লুকিয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক স্থাপনার আকার আকৃতি, দেয়াল ইত্যাদি ভেঙে এবং বিকৃত করে প্রমাণ লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ডিজিটাল এভিডেন্স, যেমন ভিডিও, অডিও, ইন্টারনেট ডেটা যেগুলো ডিলিট বা ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেগুলো রিকভার এবং রিস্টোর করার কাজ করছেন। এ কাজে দেশবাসীর কাছেও সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি।
পতিত ফ্যাসিবাদ অপপ্রচারে লিপ্ত
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । তারা নানামুখি অপপ্রচারে লিপ্ত।
দেশ একটা যুদ্ধাবস্থায় আছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন আমাদের একতাবদ্ধ থাকতে হবে যেকোনো মূল্যে । পরাজিত শক্তি এবং তাদের সহযোগীরা ওত পেতে বসে আছে আমাদের ছোবল মারার জন্য, আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেওয়ার জন্য। আমরা তাদের কিছুতেই এই সুযোগ দেব না।’
এরপর দেশবাসীকে আবারও ঈদের শুভেচ্ছা ও সালাম জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ শেষ করেন।
আপনার মতামত লিখুন :